তারাকান্দা (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি
লেখাপড়া শেষ করে সবারই প্রত্যাশা থাকে ভালো একটি চাকরির। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৮ সালে মাস্টার্স পাস করা ইন্দ্রজিতেরও এমনি প্রত্যাশা ছিল। চাকরির জন্য বিভিন্ন জায়গায় পরীক্ষাও দিয়েছেন তিনি। কিন্তু সেই সোনার হরিণ কপালে জোটেনি তার। তবে হাল না ছেড়ে অর্জিত শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে হয়েছেন উদ্যোক্তা। এখন তিনি সফল।
তরুণ উদ্যোক্তা ইন্দ্রজিতের এখন বাৎসরিক আয় প্রায় ৬ লাখ টাকা। ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার আবাইপুর ইউনিয়নের হাটফাজিলপুর বাজার সংলগ্ন এলাকার প্রেমচাঁদ বিশ্বাসের ছেলে ইন্দ্রজিত কুমার তার উদ্যোক্তা হবার গল্প বলেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ১০ শতক কৃষি জমিতে ১১০ ফুট লম্বা আর ৪০ ফুট চওড়া দেশবন্ধু মাশরুম খামার নামে একটি ঘর নির্মাণ করে সেখানে মাশরুম চাষ করা হচ্ছে। খামারে ১০ থেকে ১২ জন নারী কাজ করছেন। তারা সবাই মাদার, কাঠের গুড়ার স্পন, খড়ের সিলিন্ডার প্যাকেট তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। ঘরের মধ্যে ঝোলানো শক্ত কটের সুতা দিয়ে বানানো শিকায় স্তরে স্তরে ঝুলছে পলিথিন দিয়ে মোড়ানো মাশরুম বীজের প্যাকেট বা স্পন প্যাকেট।
ওয়েস্টার, মিল্কি ও গ্যানোডার্মা এই ৩ জাতের মাশরুম দেখা যায়। যার বর্তমান বাজার মূল্য অনযায়ী, ওয়েস্টার মাশরুম প্রতি কেজি ২৫০-৩০০ টাকা, মিল্কী মাশরুম ৩৫০-৪৫০ টাকা ও গ্যানোডার্মা মাশরুম ৪ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বর্তমানে খামারে ৫ হাজার সিলিন্ডার প্যাকেট রয়েছে।
ইন্দ্রজিত জানান, ২০১৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করেন তিনি। ২০২১ সালে ট্রেনিং নিয়ে অল্প পরিসরে মাশরুম চাষ শুরু করেন। সফলতা পেয়ে ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে বাণিজ্যিকভাবে সেড তৈরি করে মাশরুম চাষ শুরু করেন। খড়, কাঠের গুড়া, গমের ভূষিসহ সহজলভ্য কাঁচামাল দিয়ে মাশরুমের বীজ থেকে চারা উৎপাদন ও চাষ করা হয়। গত ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫ হাজার কেজি মাশরুম বিক্রি করেছেন তিনি। এখন তার মসিক আয় লাখ টাকা। তার মাশরুম ফার্মে সৃষ্টি হয়েছে ১৫ জন নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান। মাশরুমের ব্যাপক চাহিদা থাকায় এলাকায় এটি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ছড়িয়ে দেওয়ার আগ্রহ এই যুবকের।
এই খামারের টিম লিডার টুম্পা বিশ্বাস বলেন, আমি অনার্সে পড়ি। পাশাপাশি এই খামারে কাজ করি। মাশরুমের প্রতি প্যাকেট প্রস্তুত করে ৪-৫ টাকা পান। গড়ে প্রতিদিন ১৫০-২০০ টাকা কাজ করতে পারেন তারা।
ইন্দ্রজি কুমারের মা কাঞ্চন জানান, ছেলে ইন্দ্রজিত বিশ্ববিদ্যালয় লেখাপড়া শেষ করে চাকরী করেনি। চাইলে বেসরকারী কোম্পানিতে চাকরী করতে পারতো। চাকরি না কের মাশরুম খামার করেছে। আশেপাশের অনেক বেকার লোক তার খামারে কাজ করছে। অনেক মেয়েরা এই খামারে কাজ করে। এই খামারটি করাতে অনেক দরিদ্র পরিবারের বেকার ছেলে মেয়েদের কাজের সুযোগ হয়েছে। সব মিলায়ে ভালোই লাগে।
উদ্যক্তা ইন্দ্রজিত কুমার বলেন, প্রথমে ইউটিউবে কিভাবে মাশরুম চাষ করা হয় তা দেখে উদ্বুদ্ধ হই। মাগুরা ড্রিম মাশরুম সেন্টার থেকে ৪ দিনের ট্রেনিং ও ২য় পর্যায়ে সাভার জাতীয় মাশরুম উন্নয়ন ইন্সটিটিউট থেকে ৩ দিনের ট্রেনিং নিয়ে কাজ শুরু করি। পরীক্ষামূলকভাবে খড়, কাঠের গুড়া, গমের ভুষি, তুষ ও চুন দিয়ে নিজেই স্পন প্যাকেট তৈরি করে মাশুরুমের বীজ বপন করি।
তিনি বলেন, মাশরুম চাষের জন্য এক থেকে দেড় ইঞ্চি করে খড় কাটতে হয়। এরপর সিদ্ধ করে হাল্কাভাবে শুকাতে হয়। যাতে চাপ দিলে পানি না ঝরে। এরপর খড়গুলো পলিথিনের প্যাকেটে রেখে তাতে মাশরুমের মাদার দিতে হবে। প্যাকেটের মুখ বন্ধ করে কয়েকটা ছিদ্র করে দিতে হয়। এ বীজের সঙ্গে টিস্যু কালচার যুক্ত করে সঠিক পরিচর্যায় ২০ দিনের মাথায় শুরু হয় ফলন। দুই মাসে একেকটি স্পন প্যাকেট থেকে চারবার মাশরুম পাওয়া যায়।
আরও বলেন, মাশরুম চাষ আমাদের দেশে এখনো তেমন বিস্তর লাভ করেনি। তবে দেশে যে পরিমাণ বেকার রয়েছে সবাইকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই মাশরুম চাষে উদ্বুদ্ধ করতে পারলে কিছুটা হলেও বেকারত্ব দূর হবে। পাশাপাশি বিভিন্ন খাদ্যপুষ্টির চাহিদা মেটানো সম্ভব এই মাশরুম থেকে। সরকারি সহায়তা কিংবা স্বল্প সুদে ঋণ সহায়তা পেলে এ খামার বৃদ্ধির মাধ্যমে বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারবেন বলে দাবি করেন এই তরুণ উদ্দোক্তা। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ৩০ টন মাশরুম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছেন তিনি।
ঝিাইদহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উপপরিচালক আজগর আলী বলেন, মাশরুশ এমন একটি সবজি যা বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে। প্রাকৃতিকভাবে মাশরুমে সবচেয়ে বেশি ভিটামিন ও মিনারেল বিদ্যমান। মাশরুমে আছে ভিটামিন বি, ডি, পটাশিয়াম, কপার, আয়রন এবং সেলেনিয়াম। এছাড়া মাশরুমে কোলিন নামক একটি বিশেষ পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায়, যা পেশীর সক্রিয়তা ও স্মৃতিশক্তি বজায় রাখতে খুবই উপকারী। যদি কেউ নিয়মিত এই সবজিটি খেতে পারে তাহলে তার শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
আরও বলেন, মাশরুম চাষ করতে কোনো ধরনের বাড়তি জমির প্রয়োজন হয় না। যার কারণে কৃষি অফিস থেকে নারীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মাশরুম চাষে উদ্বুদ্ধ করে থাকি। তবে ইতোমধ্যে মাশরুম পুষ্টিগুণ সম্পন্ন সবজি হওয়ায় বাজারে চাহিদা বেড়েছে যার কারণে বাণিজ্যিকভাবেও এই সবজি চাষ হচ্ছে। ইতোমধ্যে ঝিনাইদহে এই মাশরুম চাষ ঘিরে বেশ কিছু উদ্যোক্তা গড়ে উঠেছে। তারা আরও ভালোভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে মাশরুম চাষ করলে মানসম্মত মাশরুম চাষ করতে পারবে।
তিনি বলেন, শৈলকুপাতে উদ্যোক্তা ইন্দ্রজিত কুমার বাণিজ্যিকভাবে মাশরুম চাষ করছেন। তিনি তার খামার থেকে বছরে প্রায় ১০ লাখ টাকার বেশি মাশরুম বিক্রি করেন। এছাড় তার খামারে অনেক নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তবে নারীরা বসে না থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে বাসা বাড়িতে অল্প করে হলেও প্রশিক্ষণ নিয়ে মাশরুম চাষ করতে পারে। এতে তার পরিবারের পুষ্টি চাহিদাও মিটবে।
ইনাম/সময়নিউজবিডি টুয়েন্টিফোর।
Leave a Reply